আপনার আদরের বিড়াল কি হঠাৎ করে আচরণে পরিবর্তন দেখাচ্ছে? স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাচ্ছে বা বেশি ঘুমাচ্ছে? হতে পারে আপনার বিড়াল মা হতে চলেছে! বাংলাদেশে বিড়াল পালনকারীদের জন্য বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ চেনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আপনি সঠিক সময়ে সঠিক যত্ন নিতে পারেন। এই সম্পূর্ণ গাইডে আমরা আপনাকে বিড়ালের গর্ভাবস্থার প্রতিটি লক্ষণ, সময়কাল এবং যত্নের বিস্তারিত তথ্য দেব।
বিড়ালের গর্ভাবস্থা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা
বিড়ালের গর্ভাবস্থা সাধারণত ৬৩ থেকে ৬৫ দিন স্থায়ী হয়, যা প্রায় ৯ সপ্তাহের সমান। তবে এটি ৬১ থেকে ৭২ দিন পর্যন্ত হতে পারে। একটি স্ত্রী বিড়াল সাধারণত ৪ থেকে ৬ মাস বয়স থেকেই গর্ভধারণ করতে পারে। তাই বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ সম্পর্কে জানা প্রতিটি বিড়াল মালিকের জন্য জরুরি।
বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ: প্রথম সপ্তাহ (১-৩ সপ্তাহ)
১. মাসিক চক্র বন্ধ হয়ে যাওয়া
গর্ভধারণের পর বিড়ালের ‘হিট সাইকেল’ বা মাসিক চক্র বন্ধ হয়ে যায়। যদি আপনার বিড়াল নিয়মিত ডাক দিত কিন্তু হঠাৎ করে থেমে গেছে, এটি বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি প্রাথমিক ইঙ্গিত হতে পারে।
২. সকালের অসুস্থতা (Morning Sickness)
ঠিক মানুষের মতোই, গর্ভবতী বিড়ালেরও প্রথম দিকে বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে। সাধারণত গর্ভধারণের ৩-৪ সপ্তাহ পর এই লক্ষণ দেখা যায়। তবে এটি সব বিড়ালের ক্ষেত্রে হয় না এবং খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় না।
৩. পিঙ্কিং আপ
গর্ভধারণের প্রায় ১৫-১৮ দিন পর বিড়ালের দুগ্ধগ্রন্থি গোলাপি এবং ফোলা হতে শুরু করে। এটিকে ‘পিঙ্কিং আপ’ বলা হয় এবং এটি বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি নির্ভরযোগ্য চিহ্ন।
বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ: মধ্যবর্তী সময় (৪-৬ সপ্তাহ)
৪. ওজন বৃদ্ধি এবং পেট ফুলে যাওয়া
এটি সবচেয়ে স্পষ্ট বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ। গর্ভধারণের ৪-৫ সপ্তাহ পর থেকে বিড়ালের পেট লক্ষণীয়ভাবে বড় হতে শুরু করে। একটি গর্ভবতী বিড়াল সাধারণত ১-২ কেজি ওজন বৃদ্ধি পায়। তবে মোটা বিড়ালের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন বুঝতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
৫. খাবারের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি
গর্ভবতী বিড়ালের খাবারের চাহিদা স্বাভাবিকের চেয়ে ১.৫ গুণ বেশি হতে পারে। যদি আপনার বিড়াল হঠাৎ করে বেশি খেতে শুরু করে এবং বারবার খাবার চায়, এটি গর্ভাবস্থার একটি সাধারণ লক্ষণ।
৬. আচরণগত পরিবর্তন
গর্ভবতী বিড়ালেরা সাধারণত বেশি স্নেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। তারা আপনার কাছাকাছি থাকতে চায়, বেশি পুর্-পুর্ করে এবং মনোযোগ চায়। কিছু বিড়াল আবার বেশি নির্জনতা পছন্দ করতে পারে।
৭. বাসা তৈরির প্রবণতা (Nesting Behavior)
গর্ভাবস্থার শেষের দিকে বিড়ালেরা বাচ্চা প্রসবের জন্য নিরাপদ ও আরামদায়ক জায়গা খোঁজা শুরু করে। তারা আলমারি, বক্স বা শান্ত কোণে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। এটি বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত যে প্রসব কাছে এসে গেছে।
বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ: শেষ পর্যায় (৭-৯ সপ্তাহ)
৮. দুগ্ধগ্রন্থি থেকে দুধ আসা
প্রসবের কয়েকদিন আগে থেকে বিড়ালের দুগ্ধগ্রন্থি থেকে দুধ আসতে শুরু করে। আপনি হালকা চাপ দিয়ে দেখতে পারেন, তবে খুব বেশি চাপ দেবেন না।
৯. বাচ্চার নড়াচড়া
গর্ভাবস্থার শেষ সপ্তাহগুলোতে বিড়ালের পেটে হাত রাখলে আপনি বাচ্চাদের নড়াচড়া অনুভব করতে পারবেন। এটি একটি চমৎকার এবং রোমাঞ্চকর মুহূর্ত!
১০. শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস
প্রসবের ২৪-৪৮ ঘণ্টা আগে বিড়ালের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক ৩৮.৫°সে থেকে কমে ৩৭.৫°সে বা তার নিচে নেমে যায়।
১১. অস্থিরতা ও চিৎকার
প্রসব বেদনা শুরু হলে বিড়াল অস্থির হয়ে পড়ে, বারবার চিৎকার করে এবং একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ঘোরাঘুরি করে।
বিড়ালের গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করার উপায়
বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ দেখার পাশাপাশি, আপনি পশু চিকিৎসকের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারেন:
পশু চিকিৎসকের পরীক্ষা
- পালপেশন (স্পর্শ দ্বারা পরীক্ষা): গর্ভধারণের ২০ দিন পর অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসক পেটে হাত দিয়ে বাচ্চা অনুভব করতে পারেন।
- আল্ট্রাসাউন্ড: ১৫-২০ দিন পর আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করা যায়।
- এক্স-রে: গর্ভধারণের ৪৫ দিন পর এক্স-রে করে বাচ্চার সংখ্যা জানা যায়।
গর্ভবতী বিড়ালের যত্ন কীভাবে নেবেন?
আপনার বিড়ালে বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ দেখার পর এই বিশেষ যত্ন নিন:
খাবার ও পুষ্টি
- উচ্চ মানের কিটেন ফুড দিন, কারণ এতে বেশি প্রোটিন ও ক্যালরি থাকে
- ছোট ছোট অংশে দিনে ৩-৪ বার খাবার দিন
- সবসময় পরিষ্কার পানি রাখুন
- ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার আগে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
পরিবেশ ও নিরাপত্তা
- বিড়ালকে ঘরের ভেতরে রাখুন, বাইরে যেতে দেবেন না
- একটি আরামদায়ক এবং শান্ত জায়গায় বাসা বানানোর ব্যবস্থা করুন
- উঁচু জায়গায় লাফানো থেকে বিরত রাখুন
- ছোট বাচ্চা বা অন্য পোষা প্রাণী থেকে দূরে রাখুন
স্বাস্থ্য পরীক্ষা
- নিয়মিত পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান
- কৃমির ওষুধ বা টিকা দেওয়ার বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
- প্রসবের আগে জরুরি যোগাযোগের জন্য পশু হাসপাতালের নম্বর রাখুন
কখন পশু চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ দেখার পর এই পরিস্থিতিতে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
- অতিরিক্ত বমি বা ডায়রিয়া
- খাবার একেবারে বন্ধ করে দিলে
- যোনিপথে রক্তক্ষরণ বা দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব
- দীর্ঘ সময় (২ ঘণ্টার বেশি) প্রসব বেদনা থাকলেও বাচ্চা না হলে
- অতিরিক্ত দুর্বলতা বা অচেতন হয়ে পড়লে
- ১০৬°ফা (৪১°সে) বা তার বেশি জ্বর
প্রসবের প্রস্তুতি
আপনার বিড়ালে বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট হলে প্রসবের জন্য এই প্রস্তুতি নিন:
প্রসব বক্স তৈরি
- একটি বড় কার্ডবোর্ড বক্স বা প্লাস্টিক বক্স নিন
- নরম কাপড়, তোয়ালে বা পুরনো বেডশিট দিয়ে বিছান বানান
- বক্সটি শান্ত, অন্ধকার এবং উষ্ণ জায়গায় রাখুন
- বক্সের এক পাশে ঢোকার জন্য নিচু প্রবেশদ্বার রাখুন
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র
- পরিষ্কার তোয়ালে এবং কাপড়
- জীবাণুমুক্ত সুতা (নাভি বাঁধার জন্য)
- জীবাণুনাশক
- গরম পানির বোতল (শীতকালে)
- জরুরি যোগাযোগের নম্বর

বিড়ালের প্রসব প্রক্রিয়া
বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণগুলো যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে, প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হয়:
প্রথম পর্যায় (৬-১২ ঘণ্টা)
বিড়াল অস্থির হয়, পুর্-পুর্ করে, বাসায় যায় এবং আসে। সংকোচন শুরু হয় কিন্তু বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
দ্বিতীয় পর্যায় (২-৬ ঘণ্টা)
শক্তিশালী সংকোচনের সাথে বাচ্চা বের হয়। প্রতিটি বাচ্চা ৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যে জন্ম নেয়। বিড়াল নিজেই বাচ্চার থলি ছিঁড়ে ফেলে এবং চেটে পরিষ্কার করে।
তৃতীয় পর্যায়
প্রতিটি বাচ্চার পর ফুল/প্লাসেন্টা বের হয়। বিড়াল সাধারণত এটি খেয়ে ফেলে, যা স্বাভাবিক।
প্রসবের পর যত্ন
- মা বিড়ালকে শান্ত এবং নির্জন পরিবেশ দিন
- প্রথম সপ্তাহে বাচ্চা না ধরাই ভালো
- মায়ের পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করুন
- বাচ্চারা দুধ পাচ্ছে কিনা লক্ষ্য রাখুন
- প্রসবের ৭-১০ দিনের মধ্যে পশু চিকিৎসকের চেক-আপ করান
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
১. বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ কতদিন পর দেখা যায়?
সাধারণত গর্ভধারণের ২-৩ সপ্তাহ পর প্রথম লক্ষণগুলো দেখা যায়। দুগ্ধগ্রন্থি পরিবর্তন হল প্রথম দিকের একটি স্পষ্ট বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ। তবে পেট ফুলে যাওয়ার মতো স্পষ্ট লক্ষণ ৪-৫ সপ্তাহ পর দেখা যায়। প্রতিটি বিড়াল ভিন্ন, তাই কারো কারো ক্ষেত্রে লক্ষণ দেরিতেও প্রকাশ পেতে পারে।
২. বিড়ালের গর্ভকাল কত দিন?
বিড়ালের গর্ভকাল গড়ে ৬৩-৬৫ দিন বা প্রায় ৯ সপ্তাহ। তবে এটি ৬১ থেকে ৭২ দিনের মধ্যে যেকোনো সময় হতে পারে এবং এটি স্বাভাবিক। যদি ৭২ দিন পার হয়ে যায় তবে অবশ্যই পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ দেখার পর থেকে আনুমানিক সময় হিসাব রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
৩. বিড়াল প্রথমবার কতগুলো বাচ্চা দেয়?
বিড়াল সাধারণত ৩-৫টি বাচ্চা দেয়, তবে এটি ১টি থেকে ৯টি পর্যন্ত হতে পারে। প্রথমবার মা হওয়া বিড়াল সাধারণত কম সংখ্যক বাচ্চা দেয়, প্রায় ২-৩টি। বয়স, স্বাস্থ্য এবং জাতের উপর বাচ্চার সংখ্যা নির্ভর করে। গর্ভধারণের ৪৫ দিন পর এক্স-রে করে বাচ্চার সংখ্যা জানা যায়।
৪. গর্ভবতী বিড়ালকে কী খাওয়াবো?
গর্ভবতী বিড়ালকে উচ্চ মানের কিটেন ফুড খাওয়ান, কারণ এতে বেশি প্রোটিন, ক্যালসিয়াম এবং ক্যালরি থাকে। দিনে ৩-৪ বার ছোট ছোট অংশে খাবার দিন। মাছ, মুরগির মাংস, ডিম (সিদ্ধ), লিভার পরিমিত পরিমাণে দিতে পারেন। দুধ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন যদি না আপনার বিড়াল অভ্যস্ত হয়, কারণ এটি ডায়রিয়া করতে পারে। বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ দেখার পর থেকে খাবারের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ান।
৫. বিড়ালের প্রসবে কি আমার সাহায্য করা উচিত?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিড়াল নিজে নিজেই প্রসব সামলাতে পারে। আপনার কাজ হল শান্তভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং জরুরি অবস্থায় প্রস্তুত থাকা। যদি ২ ঘণ্টা ধরে প্রসব বেদনা থাকে কিন্তু বাচ্চা না আসে, বাচ্চা আটকে থাকে, অতিরিক্ত রক্তপাত হয়, বা বিড়াল অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে দ্রুত পশু চিকিৎসকের সাহায্য নিন। প্রথমবার মা হওয়া বিড়ালের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকুন।
উপসংহার
বিড়ালের বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ চেনা এবং সঠিক যত্ন নেওয়া একটি সুস্থ প্রসব ও সুস্থ বাচ্চার জন্য অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বিড়ালের যত্ন নিতে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হয় যাতে মা এবং বাচ্চা উভয়ই সুস্থ থাকে। মনে রাখবেন, প্রতিটি বিড়াল আলাদা এবং তাদের গর্ভাবস্থার অভিজ্ঞতাও ভিন্ন হতে পারে। সন্দেহ হলে বা কোনো জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত একজন অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আপনার প্রিয় বিড়ালের এই বিশেষ সময়ে তাকে ভালোবাসা, যত্ন এবং নিরাপত্তা দিন। শীঘ্রই আপনি আপনার বিড়ালের পরিবারে ছোট্ট সোনালী বাচ্চাদের স্বাগত জানাবেন!
